ইসলামে যাকাতের ভূমিকা

ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাকাতকে সম্পদ বন্টনের তথা অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের মাধ্যমে সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়। মানুষের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আর তাই কুরআন মজীদে বারবার নামায কায়েম করার সাথে সাথে যাকাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাকাত আদায় ব্যতীত দ্বীন পূর্ণ হয় না। যাকাত কোন স্বেচ্ছামূলক দান নয় যা দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের অনুগ্রহ করে দেয়া হয়; বরং যাকাত ধনীর সম্পদ থেকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় নির্দিষ্ট অংশ। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম সমাজের ধনীদের সম্পদের উপর ঐ পরিমাণ যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদেরই গরিব শ্রেণির জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় এবং এই পরিমাণ যাকাত আদায় করলে তারা ক্ষুধা ও বস্ত্রহীন থাকার কষ্টের মধ্যে পড়বে না। যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। নেসাব সম্পন্ন (যাকাতযোগ্য সম্পদের অধিকারী) মুসলমানদের উপর যাকাত আদায় করা ফরয।

 

যাকাত বর্ষঃ

যাকাত ফান্ড অধ্যাদেশ অনুযায়ী হিজরি সনের ১ রমযান থেকে শাবান মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত যাকাত বর্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে। যাকাত বর্ষ হিসেবে যাকাতের আয়-ব্যয় হিসাব প্রস্তুত করা হয়।


যাকাত যোগ্য সম্পদের বিবরণ

১। স্বর্ণ-রূপার যাকাতঃ

যে কোন উদ্দেশ্যে যে কোন আকৃতিতে নিজ মালিকানায় বিদ্যমান থাকলে যাকাত ফরয শুধু স্বর্ণ হলে ৭.৫০ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম)। শুধু রূপা হলে ৫২.৫০ তোলা (৬১৬.৩৬ গ্রাম)। উভয় প্রকার মাল বা অন্য কোন যাকাত যোগ্য সম্পদের সমষ্টি রূপার নেসাব সমমূল্যের হলে এবং তা এক চন্দ্র বছর অতিক্রান্ত হলে যাকাত ফরয। স্বর্ণ রূপার সকল প্রকার অলংকারেরও একই বিধান।

২। নগদ ও নগদায়ন যোগ্য সকল প্রকার অর্থের উপর যাকাত ফরয। মুদ্রা দেশি বৈদেশিক ব্যাংকের সকল প্রকার এ্যাকাউন্টে গচ্ছিত কোন প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে জমাকৃত অর্থ, বন্ড ও ডিবেঞ্জার ও ট্রেজারী বিল ও বীমা পলিসিতে জমাকৃত অর্থ।

৩। উসূল যোগ্য প্রাপ্য ঋণ, প্রভিডেন্ট ফান্ড হতে প্রাপ্ত অর্থ, বিল অফ এ্যাকচেঞ্জ, বাকিতে বিক্রিত পণ্যের মূল্য, সিকিউরিটি এ্যাডভান্স সবই নগদ বা নগদায়নযোগ্য অর্থ হিসেবে গণ্য হবে এবং যাকাত তার উপর ফরয হবে রূপার মূল্যের ভিত্তিতে।

৪। ব্যবসা পণ্যের যাকাত

যেসব সম্পদ বিক্রি করার উদ্দেশ্যে উৎপাদন বা ক্রয় করা হয়েছে সবই ব্যবসা পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। যেমন বিক্রির উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত প্লট, জমি, ফ্ল্যাট, দোকান, গাড়ি ইত্যাদি। তাই মুদারাবা/অংশীদারী কারবারে বিনিয়োগ করলে কারাবারের নগদ কাম-ব্যবসা পণ্য, কাঁচামাল ইত্যাদির আনুপাতিক হারে তার ২.৫০% যাকাত ফরয। কোম্পানীর শেয়ার (ক্যাপিটাল গেইন) প্রকারের হলে তাও ব্যবসা পণ্য ধর্তব্য হবে এবং তার মার্কেট ভেলু হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। আমদানীকৃত পণ্যের ক্রয় সম্পন্ন হলে তার উপরও যাকাত ফরয। পোল্ট্রি ফার্মের বিক্রয় যোগ্য সম্পদ, মৎস্য খামারের বাজারমূল্য বিক্রয় যোগ্য মৎসের উপর যাকাত ফরয।

৫। উশরী জমিতে উৎপাদিত কৃষিজাত ফসল : বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত ফসলের উশর অংশ, সেচে উৎপাদিত জমির ফসলের অংশ অথবা শস্যের বাজার মূল্যের সমপরিমাণ প্রতি মৌসুমে আদায়যোগ্য।।

৬। পশু সম্পদ :

(ক) ভেড়া বা ছাগল প্রকৃতির ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩৯টি পর্যন্ত যাকাত প্রযোজ্য নয়। ৪০ থেকে ১২০টি পর্যন্ত ১টি ভেড়া/ছাগল, ১২১-২০০টি পর্যন্ত ২টি ভেড়া/ছাগল, ২০১ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ৩টি ভেড়া/ছাগল, এর অতিরিক্ত প্রতি ১০০টির যাকাত ১টি করে ভেড়া/ছাগল।

(খ) গরু, মহিষ ও অন্যান্য গবাদি পশুর ক্ষেত্রে ১ থেকে ২৯টি পর্যন্ত যাকাত প্রযোজ্য নয়। ৩০ থেকে ৩৯টি পর্যন্ত এক বছর বয়সী ১টি বাছুর, ৬০টি এবং ততোধিক হলে প্রতি ৩০টির জন্য ১ বছর বয়সী এবং প্রতি ৪০টির জন্য ২ বছর বয়সী বাছুর।

(গ) ব্যবসার উদ্দেশ্যে মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগী পালন এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি, নির্মিত বাড়ী প্রভৃতির বাজার মূল্যের হিসাব হবে যেমন ৫২.৫ তোলা রূপা (৬১৬.৩৬ গ্রাম) এর বাজার মূল্যের ২.৫% অর্থ।

যে সম্পদের যাকাত প্রদান করতে হয় না

১. জমি

২. মিল. ফ্যাক্টরী, ওয়্যার হাউজ, গুদাম

৩. দোকান

৪. বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি

৫. এক বছরের কম বয়সের গবাদি পশু

৬. ব্যবহারের যাবতীয় পোশাক

৭. বই, খাতা, কাগজ ও মুদ্রিত সামগ্রী যা ব্যবসার জন্য নয়

৮. গৃহের যাবতীয় আসবাবপত্র, বাসন-কোসন ও সরঞ্জামাদি, তৈলচিত্র ও স্ট্যাম্প

৯. মালিকানাধীন অফিসের যাবতীয় আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার ইত্যাদি সরঞ্জাম

১০. গৃহ পালিত মুরগী ও পাখি

১১. কলকব্জা, যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ইত্যাদি যাবতীয় মূলধন সামগ্রী

১২. চলাচলের যন্ত্র ও গাড়ী

১৩. যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম

১৪. ক্ষণস্থায়ী বা পচনশীল কৃষিপণ্য

১৫. বপন করার জন্য সংরক্ষিত বীজ

১৬. যাকাত বছরের মধ্যে অর্জিত সম্পদ যা সে বছরেই ব্যয় করা হয়েছে এমন সম্পদ

১৭. দাতব্য বা সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, যা জনগণের উপকার ও কল্যাণে নিয়োজিত

১৮. সরকারি মালিকানাধীন নগদ অর্থ, স্বর্ণ-রে․প্য এবং অন্যান্য সম্পদ।